আমার দাদীর মোবাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই নিয়ে সারা বাড়িতে

আমার দাদীর মোবাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই নিয়ে সারা বাড়িতে

আমার দাদীর মোবাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই নিয়ে সারা বাড়িতে এক তুলকালাম কান্ড বয়ে যাচ্ছে।

কেউ বলছেন চোরে নিয়ে গেছে আবার কেউ বলছেন হয়তো তিনি বাহিরে কোথাও ভুলবসত ফেলে এসেছেন।

কিন্তু আমার দাদীর স্পষ্ট স্বর যে একঘন্টা আগেও তিনি তাঁর ছোট ছেলে অর্থাৎ আমার ছোট চাচার সাথে কথা বলার অন্তর ডাইনিং রুমে পেতে রাখা টেবিলের উপরেই মোবাইলটি রেখেছিলেন তাহলেতো তাঁর মোবাইল বাহিরে ফেলে আসার প্রশ্নই ওঠেনা।

আমার মেঝো ফুফুর বাড়ি সব ফুফুদের তুলনায় একটু কাছেই বটে তাই তিনি এই খবর শোনামাত্র আর

একমুহূর্ত দেরী করেননি দাদীর কাছে ছুটে আসতে এমনকি সাথে ফুফাকেও নিয়ে এসেছেন।
.
আমার বাপ চাচারা তিনভাই এবং পাঁচবোন। আমার বাবা সবার বড় এরপর সিরিয়ালে পাঁচ ফুফু এবং সবার শেষে

আমার দুই চাচা। আমার বাবা আমাদের দুই ভাইবোনের পড়ালেখার খাতিরে সেই জন্মলগ্ন থেকেই ঢাকাতে

থাকেন। আমার বাবা বড় হওয়াতে গ্রামে সামান্য কোনো ঘটনা ঘটলেই সবার আগে তাঁর কানেই সেই ঘটনার

খবর আসে। আর দাদীর মোবাইল খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাটিতো বহুল আলোচিত তাই এই ঘটনাটিও বাবার কানে

আসতে বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। আমার বাবা বারবার দাদীকে জিজ্ঞেস করছেন যে ছোট চাচার সাথে কথা বলার

পর ঘরের মধ্যে কেউ এসেছিলো কিনা? কিন্তু আমার বৃদ্ধা দাদী সেরকম কিছু মনে করতে পারছেন না। বেশ

কিছুক্ষণ এভাবে জেরা করার পর অকস্মাৎ তিনি উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,

-হ হ আইছিলো। ঐ মনিরের মাইয়ায় আইছিলো আমার কাছে কি যেনো নিতে।
বলে রাখা ভালো মনির হলো আমার ছোট চাচার নাম।
তো দাদীর মুখে এই কথা শুনে আমার ফুফু আর ফুফা আমার চাচাতো বোনকে একান্তে নিয়ে বেশ কঠিন গলাতেই জিজ্ঞেস করেন,
-কিরে তুই কি মোবাইল নিছিলি?
প্রতিউত্তরে সে বারবারই নাবোধক ইঙ্গিত দিচ্ছিলো কিন্তু তবুও তাঁর না বলাতেও বেশ সন্দেহ জ্ঞাপন করে আমার ফুফা।

আমার দাদীর মোবাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই নিয়ে সারা বাড়িতে

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো আমার চাচাতো বোনকে জেরা করার সময় আমার চাচী ওর আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছিলো বোধহয় তিনি তাঁর মেয়েকে পাহারা দিচ্ছেন যাতে সে সত্যটা প্রকাশ করতে না

পারে। আমার ফুফু চাচীর এমন কান্ড দেখে তিনি বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পারেন। তাই এবার তিনি তাঁর

মেয়েকে রেখে স্বয়ং তাকেই জিজ্ঞেস করেন,
-কিরে তুই তোর মেয়ের আশেপাশে এভাবে ঘোরাঘুরি করিস কেন? আর মোবাইলতো তোর মেয়ে ছাড়া আর

কারো নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা কারণ আম্মায় লাস্ট কথা বলার পরে তোর মেয়েই একমাত্র ঘরে ঢুকেছিলো।

ফুফুর এমন কথায় চাচী কিছুটা হকচকিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই বলেন,

-আরে ও মোবাইল নিয়া কি করবে? আর নিজের দাদীর মোবাইল চুরি করলে ওর কোনো লাভ আছে?

আমার ফুফা আবার বেশ চালাক মানুষ তাই তিনি আসল সত্যটা উদঘাটনের জন্য আমার চাচীকে একটু আড়ালে নিয়ে নীচু গলায় বলে উঠলেন,

-শোন আমি জানি মোবাইল তোর মেয়েই নিছে। আর ও যে নিয়েছে সেটার সবকিছুই তুই জানিস।

তুই আমারে আসলটা বল আমি কাউকে কিছু বলমুনা।
ফুফার এমন কথায় আমার চাচী কিছুটা ইতোস্তত ভঙ্গিতে বললেন,
-আসলে ও নাকি মোবাইলটা নিয়া ভাইজানগো পুকুরে ফালাইছে।
এই বলেই তিনি মুখে কুলুপ এঁটে নিলেন।
অতঃপর পুকুরের মধ্যে অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে মোবাইলটি পাওয়া গেলো। আর এই মোবাইলটি যে

কে ফেলেছে সেটাও কারো বুঝতে বাকি রইলোনা। কারণ আমার চাচাতো বোনের সাথে আমার দাদীর বিন্দুমাত্র

শত্রুতা নেই যে সে ঘর থেকে মোবাইল চুরি করে পুকুরে ফেলে দিবে। উল্টো এর পিছনের কারিগর হলেন স্বয়ং

আমার চাচী নিজেই। কারণ আমার চাচীর স্বভাবটা ছিলো এমন যে তিনি কখনোই চাইতেন না আমার ছোট চাচা

আমার দাদীকে কোনো টাকাপয়সা দিক কিন্তু আমার চাচা ছিলেন বেশ মা ভক্ত ওয়ালা লোক তাই তিনি বউয়ের

কথার থেকেও মায়ের কথাকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। আর তাছাড়া আমার দাদীও তেমন সুবিধার লোক ছিলেন না

কেননা তিনি ছেলের মা ভক্তের দুর্বলতাকে পুঁজি করে প্রায়শই বউয়ের নামে ছেলের নিকট ফোন দিয়ে কান

ভারী করতেন। আর এই ঘটনার রেশ ধরেই হয়তো আমার চাচী দাদীর মোবাইলটি রাগ করে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন।

এসব ঘটনা যখন আমার চাচার কানে চলে গেলো তখন তিনি একমুহূর্ত দেরী করেননি সুদূর শহর থেকে গ্রামে

চলে আসতে। আর গ্রামে এসেই তিনি চাচীকে অনেকটা ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন এবং

সাফ সাফ বলে দেন,
-যদি আমার মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইতে পারিস এবং আমার মা যদি তোকে ক্ষমা করে তবেই এই বাড়িতে পা

দিবি নয়তো এই বাড়ির ত্রিসীমানায় তোকে দেখলে ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দিবো।

আমার চাচী সেই মুহূর্তে চাচার কথায় যে বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

কারণ শাশুরীর সামান্য মোবাইল ফেলে দেওয়ার কারণে যে তাকে তাঁর স্বামী বাড়ি ছাড়া করবে সেটা যেন তাঁর ভাবনাতেই ছিলোনা।
সেই ঘটনার পর কেঁটে যায় দীর্ঘ দুমাস…

একদিন হঠাৎই আমার বাবার মোবাইলে আমার মেঝো ফুফুর কল আসে। অপর পাশ থেকে ফুফুর কান্নাজড়িত

কন্ঠ শুনে আমার বাবা সহসাই রক্তিম চোখে এবং ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে আমাদেরকে বলে উঠেন,

-অতিদ্রুত রেডি হও, এখনি গ্রামে যেতে হবে। আমি বাসের টিকিট কেঁটে আনছি।

বাবার এমন তাড়াহুড়ো দেখে আমরা বেশ অবাক হলাম। মূল ঘটনা জানার জন্য তৎক্ষনাৎ আমার মা গ্রামে

কল দিয়ে জানতে পারেন আমার দাদী নাকি বিষ খেয়েছে। এমন কথা শুনে আমরা সকলেই হতভম্ব হয়ে যাই

কারণ আমার দাদী একজন পরহেজগার মানুষ তাই স্বদিচ্ছায়তো তাঁর বিষ খাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।
.
দাদীকে উঠোনের মাঝে স্টিলের খাঁটিয়াতে সাদা কাপড় দিয়ে বেশ যত্ন সহকারে ঢেকে রাখা হয়েছে।

গ্রামের রেওয়াজ অনুযায়ী কোনো বৃদ্ধ পুরুষ বা মহিলা মারা গেলে আশেপাশের শত্রুরাও একটুখানি কষ্ট লোপণ

করে কান্না করবে এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না।

আমার বাবা দাদীকে একনজর দেখে নিজের দুফোঁটা অশ্রুবিসর্জন দিলেন, এখনো দাদীর মুখ দিয়ে সাদা ফ্যানা বের হচ্ছে।

পরমুহূর্তেই আমার বাবা দাদীর নিথর দেহ থেকে নিজেকে সরিয়ে আমার দুই চাচা এবং ফুফাদের নিয়ে আলাদাভাবে বসে পরলেন।

সবারই এককথা দাদীর নিজ ইচ্ছায় বিষ খাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা হয়তো তাঁর খাবারে কেউ শত্রুতার বশে তাঁর

অজান্তেই বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কে মিশিয়েছে? কার সাথে তাঁর এতো শত্রুতা?

সবার আঙ্গুল আমার ছোট চাচীর দিকে উঠলেও তিনিতো সেই মোবাইল ফেলে দেওয়ার ঘটনার পর থেকেই বাপের বাড়িতে থাকেন।

তবে কে করলো এমন কাজ?
ভরা মজলিশের মাঝে হঠাৎই আমি বলে উঠলাম,

-চাচীতো লোক দিয়েও এই কাজ করাতে পারে।

আমার কথায় সবার হুঁশ ফিরলো বোধহয় তবে এটাও সত্যি যে কাউকে কোনো প্রমাণ ছাড়া দোষী বানানো ভারী

অন্যায়। ইতোমধ্যে আমার মেজো চাচা পুলিশকেও খবর দিয়েছেন তবে গ্রামের পুলিশদের যা অবস্থা তাতে মনে

হয় তাঁরা সত্য উদঘাটন করতে গিয়ে উল্টো হযবরল অবস্থা করে ফেলবে এবং সবশেষ এটাকে আত্মহত্যা বলে

চালিয়ে দিবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যা করার নিজেই করবো কারণ ছোটবেলা থেকেই ক্রাইম পেট্রোল আর

সিআইডি দেখতে দেখতে গোয়ান্দাগিরি সম্পর্কে আমার বেশ ভালোই ধারণা রয়েছে। মেঝো ফুফা বেশ চালাক

প্রকৃতির লোক হওয়ায় তাকেও আমার সাথে নিয়ে নিলাম।
.
দাদীর ঘরের পেছনের দিকে একটি বড় আকারের পায়ের ছাপ দেখে আমার বিন্দুমাত্র বুঝতে বাকি রইলোনা যা করার এই অজ্ঞাত লোকটিই করেছে।

কিন্তু সামান্য এই পায়ের ছাপ দিয়েতো আর আসল লোককে বের করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

প্রায় আধঘন্টা যাবৎ খোঁজাখুঁজির পরও যখন তেমন কোনো ক্লু পাচ্ছিলাম না ঠিক সেইসময়টিতেই কিছু ভিসিটিং কার্ড আমাদের সকল রহস্য উন্মোচনের সুযোগ করে দেয়।

অতঃপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এবং পুলিশের সহযোগীতায় আমরা জানতে পারি দাদীকে বিষ খাওয়ানোর পিছনে আর কারো

হাত নেই স্বয়ং আমার চাচীরই হাত রয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন দাদীকে পরকালে পাঠিয়ে পুনরায় আবার

এবাড়িতে ফিরে এসে নিজের আসনে সমাসীন হতে।

তবে তাঁর সে আশাতো পূরণ হলোইনা উল্টো এই নিকৃষ্ট কাজের দরুন আজ তাকে জেলের ভাত খেতে হবে।

.
দাদী মারা যাওয়ার তিনদিন পর সকলে আবারো মজলিশে বসেছেন।

সকলের মুখেই এখন চাচীকে হেয় করার বাক্যবিন্যাস উঁকিঝুকি দিচ্ছে, কেউ আবার চাচীর বাপের বাড়ির লোকদেরও গালিগালাজ করছে।

পরক্ষণেই আমার ছোট চাচা বলে উঠলেন,
-আমার উচিৎ ছিলো যেদিন ও মায়ের মোবাইল পানিতে ফেলে দিয়েছে সেদিনই ওকে তালাক দিয়ে দেওয়া কিন্তু

মেয়েদের কথা চিন্তা করে সেদিন তালাক দেইনি। এটাই আমার বড় ভুল ছিলো।

সবাই তাঁর কথায় সায় দিলেও আমি অকস্মাৎ বলে উঠলাম,
-এই সব ঘটনার মূলে কিন্তু আপনিই রয়েছেন সেটা কি জানেন?

আমার কথায় সবাই হতবিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে রইলো।

-আপনিতো বরাবরই একজন কাপুরুষের ভূমিকা পালন করেছেন কারণ আপনি কখনোই স্ত্রী আর মায়ের মাঝে

সমতা বিধান করতে পারেননি। উল্টো দাদীর কথায় আপনি সবসময় নেচেছেন এবং সবকথা চোখ বুজে বিশ্বাস

করেছেন অপরদিকে স্ত্রীর কোনো কথাকেই দাম দেননি। একটি সত্যি কথা কি জানেন, বউ শাশুরীর যুদ্ধের

মধ্যে তাঁদের পরস্পরের যতটা দোষ থাকে তাঁর থেকেও বহুলাংশে দোষী একজন ছেলে নিজেই।

কারণ সে বোকার মতো একদিকে ঝুঁকে পরে বলেই আজ ঘরে ঘরে মায়ের সাথে ছেলের কিংবা স্ত্রীর সাথে স্বামীর

বিচ্ছেদের কথা শোনা যায়। তাঁদের মাঝে প্রতিহিংসা সৃষ্টি করার মূল কারিগরতো আপনি নিজেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *