নওগাঁ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধশালী এলাকা, যা তার ঐতিহ্যবাহী হাট-বাজার এবং সুস্বাদু খাবারের জন্য পরিচিত। এই জেলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য হাট হলো উমইল হাট, যা স্থানীয়দের পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। এই প্রবন্ধে আমরা উমইল হাটের অবস্থান, ইতিহাস, এবং প্রসিদ্ধ খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
উমইল হাটের অবস্থান ও ইতিহাস
উমইল হাট নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলায় অবস্থিত। এটি মহাদেবপুর উপজেলার উমইল ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি প্রাচীন হাট, যা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বসে। উমইল হাটের সুনাম ও জনপ্রিয়তা কেবল স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলা থেকেও ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা এখানে সমবেত হন।
উমইল হাটের ইতিহাস বেশ পুরনো। স্থানীয়দের মতে, এই হাট প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ শাসনামলে, যখন এটি ছিল স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পণ্য বিনিময়ের অন্যতম কেন্দ্র। সময়ের সাথে সাথে হাটের পরিসর ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এটি এখন নওগাঁ জেলার অন্যতম বৃহত্তম হাট হিসেবে পরিচিত।
হাটের পরিবেশ ও পণ্যের বৈচিত্র্য
উমইল হাটে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে এর প্রাণবন্ত পরিবেশ। হাটের প্রতিটি কোণায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের কোলাহল, পণ্যের সমারোহ, এবং স্থানীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়। হাটে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পাওয়া যায়, যেমন:
- কৃষিজ পণ্য: ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, এবং অন্যান্য শাকসবজি।
- মৎস্য ও মাংস: তাজা মাছ, মুরগি, হাঁস, গরু ও ছাগলের মাংস।
- হস্তশিল্প ও কুটির শিল্প পণ্য: মাটির পাত্র, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গি।
- গৃহস্থালী পণ্য: রান্নার উপকরণ, গৃহসজ্জার সামগ্রী, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
উমইল হাটের প্রসিদ্ধ খাবার
উমইল হাট কেবল পণ্যের জন্যই নয়, তার সুস্বাদু খাবারের জন্যও বিখ্যাত। হাটে আসা ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা বিভিন্ন স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে পারেন। নিচে উমইল হাটের কিছু প্রসিদ্ধ খাবার তুলে ধরা হলো:
১. পিঠা-পুলি
উমইল হাটের পিঠা-পুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শীতকালে বিভিন্ন ধরনের পিঠা পাওয়া যায়, যেমন:
- ভাপা পিঠা: চালের গুঁড়ো ও নারিকেল দিয়ে তৈরি এই পিঠা গরম গরম পরিবেশন করা হয়।
- চিতই পিঠা: মাটির পাত্রে তৈরি এই পিঠা গুড় বা ভর্তার সাথে খাওয়া হয়।
- পাটিসাপটা: নারিকেল ও খেজুরের গুড়ের পুর দিয়ে তৈরি এই পিঠা সবার প্রিয়।
২. চটপটি ও ফুচকা
হাটের বিভিন্ন স্থানে চটপটি ও ফুচকার স্টল দেখা যায়। মসুর ডাল, আলু, টমেটো, পেঁয়াজ, ধনেপাতার মিশ্রণে তৈরি চটপটি এবং মচমচে ফুচকা স্থানীয়দের পাশাপাশি ভ্রমণকারীদেরও মন জয় করে।
৩. মিষ্টান্ন
উমইল হাটের মিষ্টান্নের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- রসগোল্লা: নরম ও রসালো এই মিষ্টি সবার প্রিয়।
- লালমোহন: খয়েরি রঙের এই মিষ্টি বিশেষভাবে সুস্বাদু।
- সন্দেশ: বিভিন্ন স্বাদের সন্দেশ হাটে পাওয়া যায়।
৪. ভর্তা ও ভাজি
হাটের খাবারের দোকানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা ও ভাজি পাওয়া যায়, যেমন:
- আলু ভর্তা: সরিষার তেল ও পেঁয়াজ দিয়ে মাখানো আলু ভর্তা।
- বেগুন ভর্তা: পোড়া বেগুন, পেঁয়াজ, মরিচ ও ধনেপাতার মিশ্রণে তৈরি।
- কচু শাক ভাজি: সরিষার তেলে ভাজা কচু শাক।
৫. স্থানীয় মাছের তরকারি
উমইল হাটের কাছাকাছি নদী ও পুকুর থেকে আহরিত তাজা মাছ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন তরকারি হাটের বিশেষ আকর্ষণ। বিশেষ করে টেংরা, পুঁটি, শিং, মাগুর মাছের তরকারি স্থানীয়দের পাশাপাশি ভ্রমণকারীদেরও প্রিয়।
হাটে আসার উপায়
উমইল হাটে আসার জন্য নওগাঁ জেলা শহর থেকে মহাদেবপুর উপজেলার উমইল ইউনিয়নে যাতায়াত করতে হবে। জেলা শহর থেকে বাস, অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলে করে সহজেই হাটে পৌঁছানো যায়। হাটের দিনগুলোতে বিশেষ পরিবহন সুবিধা থাকে, যা ক্রেতা ও বিক্রেতাদের যাতায়াত সহজ করে।
সমাপনী কথা
উমইল হাট নওগাঁ জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাণবন্ত হাট, যা স্থানীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাটের বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি সুস্বাদু খাবার এর বিশেষ আকর্ষণ। যারা নওগাঁ জেলায় ভ্রমণ করবেন, তারা উমইল হাটে এসে এখানকার পরিবেশ ও খাবারের স্বাদ নিতে পারেন।