এ্যাক্সিডেন্ট হয়ে এক পা ভেঙ্গে যাওয়ার দরুন আমাকে অফিস থেকে জরুরী ভিত্তিতে অব্যহতি দেওয়া হয়। যদিও আমার নিজেরই এই পঙ্গু পা নিয়ে আগামী দুই তিনমাস অফিসের গেইট পার হবার সক্ষমতাও নেই।
আমার চাকরীটি থাকবে কিনা এই নিয়েও বহু সংশয় আমার মনে উঁকিঝুকি দিচ্ছে।
অফিসের এমডি সাহেব আমাকে বেশ আশ্বস্ত করেই বলেছিলেন,
-মারুফ সাহেব! আপনি চিন্তা করবেন না।
আপনি সুস্থ হলেই আপনাকে নতুনভাবে অফিসের দায়িত্বে পদার্পণ করানো হবে।
কিন্তু সমস্যা হলো চাকরীতে পুনরায় জয়েন হওয়ার আগপর্যন্ত আপনাকে কোনো বেতন দেওয়া সম্ভব নয়। বুঝেনইতো এটা একটি বেসরকারী কোম্পানী।
আমি তখন হাসিহাসি মুখে এমডি স্যারকে বলেছিলাম,
-আমার কোনো সমস্যা নেই স্যার।
সুস্থ হওয়ার পর আমাকে চাকরীতে নিয়ে নিলেই হবে এটাই আমার নিকট যথেষ্ট। আমিও মূলত কাজ না করে বেতন নেওয়া পছন্দ করিনা।
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
এই কথাটা যদিও আমি বড় গলায় তখন এমডি স্যারকে বলেছিলাম তবে আমার মনের অবস্থাটা ছিলো অন্যরকম।
কারণ করোনা মহামারীর কারণে অফিসের বহু কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছিলো আর সেখানে আমার চাকরীটা পুনরায় ফেরৎ পাওয়াটাই অনেক বড় কিছু ছিলো এইসময়টিতে আমার জন্য।
ডাক্তার বলেছেন আগামী দুই তিনমাসের আগে আমার হাঁটাচলা করাটা একদমই শোভা পাবেনা বরং আমাকে চলতে হবে হুইলচেয়ারের সাহায্য নিয়ে।
আগে যখন রাস্তা দিয়ে কোনো পঙ্গু মানুষকে হুইলচেয়ারের সাহায্যে চলতে দেখতাম তখন বুঝতাম না যে তাঁদের হাঁটতে না পারার কষ্টটা কতটা প্রখর হতে পারে কিন্তু আজ আমি খুব হারে হারেই টের পাচ্ছি।
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
ঢাকার শহরে কোনো কাজকর্ম না করে বসে বসে খাওয়াটা তিলে তিলে মারা যাওয়ারই অনুরূপ।
এ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত আমার স্ত্রী মিমি আমাকে যতটা যত্ন করেছে তার হিসাব চুকে শেষ করা যাবেনা। অথচ বিয়ের পর থেকেই মেয়েটিকে আমি কতটা অবহেলা করেছি।
আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন আমার শিশুকালেই। মা তখন দ্বিতীয় বিয়ে না করে আমাকে নিয়ে প্রতিনিয়তই সংগ্রাম করে গিয়েছেন।
অল্পবয়সে বাবা মারা যাওয়ার দরুন আমার দাদাবাড়ির লোকজন আমাকে এবং আমার মাকে বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। দাদা বাড়িতে তখন সম্মান না পেয়ে মা চলে আসেন নানা বাড়িতে।
কিন্তু আমার সৎ মামাদের পীড়াপীড়িতে সেখানেও মা বেশিদিন স্থির থাকতে পারেননি।
তাই কোনোকিছু না ভেবেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন এই ব্যস্ত নগরী ঢাকার উদ্দেশ্যে।
বিভিন্ন জায়গাতে আমার মা পরিশ্রম করে তাঁর সমপর্যায়ের নারীদের মতো তিনি আমাকে কাজকর্মে ঢুকিয়ে না দিয়ে আস্তে আস্তে শিক্ষিত করে তুলেন।
সত্যি বলতে মা পড়ালেখার কোনো চাহিদার ক্ষেত্রে টাকা ঢালতে কার্পণ্য করেননি।
উল্টো যখন বিভিন্ন পরীক্ষার আগমুহূর্তে স্কুল কলেজের বেতন আর ফি প্রদানের বার্তা আসতো তখন মা এক সাথে দুই তিন জায়গাতেও কাজ করেছিলেন।
পড়ালেখা শেষ করে চাকরীও নিয়েছি তবে সরকারী চাকরী বোধহয় আমাদের মতো নিম্নবিত্তের কপালে কোনোকালেই ছিলোনা।
তবুও প্রভুর কল্যাণে একটি বড়সড় বেসরকারী কোম্পানীতে চাকরীটা হয়েই গিয়েছিলো।
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
ভার্সিটি জীবন থেকেই আমি একটি মেয়েকে পছন্দ করতাম মেয়েটিও আমাকে পছন্দ করতো।
চেয়েছিলাম সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে মাকে নিয়ে এক সুখি পরিবারের মতো পুরোটা জীবন পার করে দেবো।
কিন্তু আমার সেই আশার আলোতে পানি ঢেলে আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিলেন স্বয়ং আমার মা নিজেই।
মায়ের বিরুদ্ধে আমি কোনোকালেই যেতে পারিনি এবং কখনো পারবোও না কারণ এই মাইতো আমার জন্য নিজের সকল সুখ দুঃখকে বলি দিয়ে প্রতিমুহূর্তেই সংগ্রাম করে গিয়েছেন।
তাহলে এই মায়ের বিরুদ্ধে গেলে প্রভু কি কখনো আমাকে ক্ষমা করবেন? কখনোই না!
অতঃপর নিজের পছন্দকে মাটি চাপা দিয়ে আমি বিয়ে করেছিলাম মায়ের পছন্দ করা মেয়ে মিমিকে।
সত্যি কথা বলতে একটি মেয়ের স্বামীর প্রতি যতটা করণীয় কিছু আছে তার থেকেও বোধহয় একটু বেশিই করতো সে।
সংসারের যাবতীয় সবকিছুই এতোটা নিখুঁতভাবে গুছিয়ে রাখতো যে মনে হতো আমাদের এই ছোট্ট ঘরটাও একটি রাজপ্রাসাদের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
তবুও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিমিকে বিয়ে করাতে শুরু থেকেই ওকে মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। মিমিও এসব কিছু খুব ভালো করেই বুঝতো কিন্তু কখনো এই নিয়ে টু শব্দটিও করতো না।
কিন্তু বর্তমানে আমার এই পঙ্গুত্ব পরিস্থিতিতে আমি খুব করেই বুঝতে পারছি আমার মা কোনো ভুল মেয়েকে তাঁর ছেলের বউ বানাননি।
কেননা এই অসুস্থতার মধ্যেও মিমি নিঃস্বার্থভাবে আমাকে সবকিছু এগিয়ে দেওয়া কিংবা ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া কোনোকিছুই বাদ ছিলোনা।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো মিমি আমার এতোসব যত্নআত্তি করা সত্ত্বেও ওর মুখে কখনোই আমি বিরক্তিভাব দেখিনি।
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
এ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার তিনমাস কেঁটে গেছে কিন্তু এখনো আমি ঠিকভাবে হাঁটতে পারছিনা।
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
এই তিনমাস পুরোপুরি বসে খাওয়ার দরুন ব্যাংকে যতটুকু সঞ্চয় ছিলো তাও প্রায় শেষ পর্যায়ে।
আর এদিকে আমার মুমূর্ষু অবস্থা দেখে বাড়িওয়ালা এই কমাসে ভাড়ার ব্যপারে তেমন কিছু না বললেও সেদিন হঠাৎই এসে বললো,
-ভাই! আপনার অসুস্থতা দেখে তেমন কিছু বলিনি।
কিন্তু আপনার তিনমাসের ভাড়া ঝুলে আছে, দিলেন তো না আর।
তাঁর এভাবে ভাড়া চাওয়াতে আমি বেশ লজ্জাই পেলাম বটে।
কারণ আগে কখনোই তিনি আমার নিকট ভাড়া চাওয়ার সুযোগই পাননি কেননা তাঁর যে কয়জন ভাড়াটিয়া আছে সবার আগে আমিই তাঁর নিকট ভাড়াটা পৌঁছে দিতাম।
এখানে তাকে দোষ দিয়েও বা কী লাভ? ফ্ল্যাটে ভাড়া যেহেতু থাকছি তাই ভাড়াটাতো দিতেই হবে।
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
এদিকে ব্যাংকে যেই টাকা আছে তা দিয়ে যদি ভাড়ার টাকা দিয়ে দেই তবে আমাদের সকলকে না খেয়েই কাঁটাতে হবে। আমি পুনরায় অনেকটা কষ্ট করেই আমার অফিসের এমডির নিকট হাজির হলাম।
তিনি আমাকে দেখেই কেমন যেন একটা গা ছাড়া স্বভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। আমি বিষয়টা বুঝতে পেরেও অনেকটা আকুতিমাখা স্বরেই তাকে বললাম,
-স্যার আপনিতো বলেছিলেন আমি সুস্থ হলে পুনরায় অফিসে জয়েন করতে পারবো।
এমডি সাহেব আমার কথায় কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললেন,
-আসলে মারুফ সাহেব! আপনার জায়গাতে একজন নতুন লোক জয়েন করেছে।
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
আপাতত আপনাকে আমি নিতে পারছিনা। তবে আগামী মাসে কেউ চাকরী ছেড়ে দিলে আপনাকে নেওয়া হবে।
বুঝেনইতো এটা বেসরকারী কোম্পানী, অতিরিক্ত লোক রেখে বেতন দিলে কোম্পানী চলবে কী করে?
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
এমডি স্যারের কথায় আমার বুক ফেঁটে প্রচন্ড কান্না আসলেও তাঁর সামনে সেটা চেপে রেখে শান্ত গলায়
বললাম,
-আচ্ছা স্যার সমস্যা নেই।
এই বলেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে তাঁর সামনে থেকে চলে আসলাম। আমি জানি এই মহামারীতে কোনো লোকই চাকরী
ছাড়বেনা আর আমারও আর জয়েন করা হবেনা।
আমার মা আমাকে রক্তিম চোখে বাড়িতে ফিরতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি আবার?
আমি হাসিমাখা মুখে উত্তর দিলাম,
-না মা কিছু হয়নি। তুমি ঔষধ খেয়েছো?
-হ্যাঁ খেয়েছি।
আমি আর কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে আসলাম। এই মুহূর্তে যে আমি কিভাবে কি করবো তা যেন
আমার ভাবনাতেই আসছে না। বিপদ আল্লাহ যদি দেয় তবে সবগুলো বোধহয় একত্রেই দিয়ে দেয়।
অকস্মাৎ আমার মা একটি কাপড়ের পোটলা নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। আমি বেশ অবাক হয়ে মাকে
জিজ্ঞেস করলাম,গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
-এটাতে কী মা?
তিনি আমার পাশে বসে উৎফুল্ল নয়নে বলে উঠলেন,
-তেতাল্লিশ হাজার টাকা আছে। তুই আপাতত এগুলো দিয়ে সব দেনাপাওনা পরিশোধ কর।
আর আমার মনে হয় তোকে এই চাকরীতে আর নিবেনা। তাই আমি কুদ্দুস ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি তিনি
বলেছেন তাঁর গার্মেন্টস এর হিসাব কিতাবের জন্য একজন লোক প্রয়োজন। বেতন যদিও তোর চাকরীর মতো
অতো বেশি পাবিনা কিন্তু অনেক ভালোই তিনি দিবেন বলছেন। যা দিয়ে আমাদের সবার চলে যাবে।
আমি মায়ের উৎফুল্ল মুখখানার দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কারণ আমার মা কখনোই
টাকা জমা করার মতো মানুষ নয় বরং হাতে টাকা থাকলে যতক্ষণ পর্যন্ত না টাকা শেষ হয়ে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত
তিনি খরচ করতেই থাকবেন। আমি অনেকটা কৌতুহলী হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
-তুমি কি এতোগুলো টাকা নিজেই জমিয়েছো?
-আরে নাহ! আমার হাত কি টাকা জমানোর হাত নাকি? আসলে তোর বউরে তুই মাসে মাসে হাত খরচের জন্য
যে অল্প স্বল্প টাকা দিতি ঐগুলা সে ব্যাংকে জমা করে রেখেছিলো। মেয়েটা কতো লক্ষ্মী দেখছিস?
এখন আমাদের বিপদের মুহূর্তে কিন্তু টাকাগুলো ঠিকই কাজে লেগে গেলো।
মায়ের কথা শুনে আমি যেন আর কিছু বলার ভাষ্যই হারিয়ে ফেললাম।
একমুহূর্ত দেরী না করে আমি টাকার বান্ডেলটা হাতে নিয়ে মিমির উদ্দেশ্যে রান্নাঘরের দিকে ছুটে চললাম।
মিমি তখনো একমনে রান্না করেই চলছিলো কিন্তু আমি যে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছি সেদিকে যেন তাঁর
খেয়ালই নেই। আমি শান্ত স্বরে মিমিকে ডাক দিতেই সে পেছনে ফিরে তাকালো। আমার হাতে তাঁর দেওয়া
টাকার বান্ডেলটা দেখে সে কিছুটা লজ্জা পেলো বোধহয়। নীরবতা ভেঙ্গে আমি মায়ামাখা স্বরে বলে উঠলাম,
-তোমার মতো জীবনসঙ্গীনী পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য। জানো সেটা?
গল্প দায়িত্ববোধ:লেখকঃ মিস্ক আল মারুফ শেষ পর্ব আজকে
মিমি আমার কথা শুনে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখের বাঁধ পার হওয়া জলটুকু মুছে আমাকে বললো,
-আমিও তোমাকে পেয়ে ধন্য।
হয়তো সে এতোগুলো দিন পর নিজের স্বামীর মন জুড়ে পরিপূর্ণ জায়গাটা দখল করতে পেরে সুখের কান্নাটুকুকে আর আটকে রাখতে পারেনি। আর এই মুহূর্তগুলোই বোধহয় পৃথিবীর সবথেকে সুখকর কিছু মুহূর্ত যেগুলো কোনো অর্থের বিনিময়ে কেনা যায়না বরং ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকে আপনা আপনিই তৈরি হয়।
(সমাপ্ত)