তরুণ আইনজীবীর স্পিরিচুয়াল ক্রাইসিস জহিরুল ইসলাম মুসা

তরুণ আইনজীবীর স্পিরিচুয়াল ক্রাইসিস জহিরুল ইসলাম মুসা

Rate this post

একজন আইনজীবীকে আইন পেশার শুরু থেকে নানান ধরণের স্ট্রাগল ও ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

আইনজীবীর ইনকামের বা জুনিয়রশিপের স্ট্রাগল নিয়ে বিভিন্ন সময় কিছু কিছু আলোচনা হলেও, আইনজীবীর স্পিরিচুয়াল ক্রাইসিস নিয়ে খুব বেশি আলোচনা দেখা যায় না।

হালাল-হারাম প্রশ্নে আইনজীবীর ইনকাম খুব সূক্ষ্ম এক রেখার ওপর দাড়িয়ে থাকে। খুব সূক্ষ্ম।

ক্লায়েন্ট ডিলিংসে বা কাজে-কর্মে একটু এদিক-ওদিক হলেই, ইনকাম হারাম হয়ে যেতে পারে।

আমার নিজের পেশাগত জীবনে যত ক্লায়েন্টেক সার্ভিস দিয়েছি, তার চেয়ে বেশি ক্লায়েন্টকে সার্ভিস দিতে পারি নাই বা আমার থেকে সার্ভিস না নিয়েই চলে গেছেন।

কারণটা সহজ। অনেক ক্লায়েন্ট চায়, রেমেডি পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা—সোজা কথা ‘গ্যারান্টি’।

আমি যেটা ব্যক্তিগতভাবে কখনোই দেই নাই। নিজে নিশ্চিত হলেও দিতে পারি না; কারণ শেষ পর্যন্ত রেমেডি

দিবেন বিচারক। অথচ কখনো কখনো ক্লায়েন্ট এটাকে আমার পেশাগত দুর্বলতা ভেবে চলে যান। আমিও খুশি

মনে বিদায় জানাই। কিছু কিছু ক্লায়েন্ট হয়তো ফিরে আসেন, কিন্তু ততদিনে তার মামলায় ক্ষতি হয়ে যায় বা

অন্য বিজ্ঞ আইনজীবী সম্পর্কে বাজে ধারণার জন্ম নেয়।

এই কাজটা সহজ না। বিশেষ করে তরুন/স্ট্রাগলিং আইনজীবীদের জন্য অবলীলায় (শুধুমাত্র হালাল-হারাম প্রশ্নের সুরাহা করে) ক্লায়েন্ট ছেড়ে দেয়া খুব কঠিন।

তো, এইযে রিযিকের মালিক আল্লাহ, এই ঈমান বজায় রেখে ধৈর্য্য ধারণ করতে গিয়ে আইনজীবীকে বড় ক্রাইসিস মোকাবেলা করতে হয়।

এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্যের সাথে আলোচনা করা যায় না, নানান প্রটোকল-ভয়-হীনমন্যতার কারণে। সবকিছু গিয়ে আঘাত হানে স্পিরিচুয়ালিটিতে। আস্তে আস্তে ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। টের পাওয়া যায় না।

আবার আইনজীবী পেশাগত সততা ও শুদ্ধাচার বজায় রেখে ক্লায়েন্টকে সার্ভিস দিতে গিয়েও ছোট-ছোট অনিয়মের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

এইটা অধস্তন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত, সব আদালতেই।

কাঙ্খিত রিলিফ পাওয়ার পর কোর্ট স্টাফ বা আদালত সংশ্লিষ্ট অনেককে ঘুষ দিতে হয়।

যেমন ধরেন, জামিনের আদেশ পাওয়ার পর সেটা টাইপ করানো থেকে শুরু করে যতগুলো টেবিল/অফিস ঘুরবে, সবখানে ঘুষ দিতে হয়।

ক্লায়েন্টের যত আর্জেন্সি, যত বেশি বিপদ, ঘুষের পরিমাণ তত বেশি। না দিলে কি যে হয়রানি, সেটা ভুক্তভোগী সবাই জানে। এগুলো জেনে-বুঝে-মেনে নিয়েই চলতে হয়।

তাল মিলিয়েই চলতে হয়। এইখানে হাদিস-কোরআন-নীতিকথা চলে না।

এইটা করতে গিয়ে আস্তে আস্তে অন্তর মরে যায়। বুঝতে পারা যায় না।

আইনজীবী হিসেবে টিকে থাকতে বা নাম করতে বা বড় হতে গিয়ে নিজের ‘soul’ কে বিক্রি করে দিতে হয়।

কিন্তু কিসের বিনিময়ে? খুব সামান্য কিছু ফিস, নাকি নিজের স্পিরিচুয়ালিটি, নাকি পরকাল? জানি না।

আবু দাউদ শরীফের এক হাদিসে এসেছে, ‌রাসুলুল্লাহ (সা.) বিচারকার্যে ঘুষখোর ও ঘুষদাতাকে অভিসম্পাত করেছেন।

বাংলাদেশের জং ধরা বিচার ব্যবস্থায় অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতাপ্রীতি, সিনিয়রপ্রীতিসহ নানান অবব্যস্থাপনা, হাহাকার, কষ্ট, তাচ্ছিল্য, অপমান, জুলুম দেখতে দেখতে তরুণ আইনজীবীদের স্পিরিচুয়াল ক্রাইসিস চরমে পৌঁছে যায়। যা মোকাবেলা করা খুব কষ্টকর।

খুব। এই ক্রাইসিস অনেকেই বুঝতে পারেন না। অনেকে হেসে উড়িয়ে দেন।

অনেকে সিম্পলি তাচ্ছিল্য করেন।

কিন্তু এটা যে আইনজীবীর জীবনে অন্যতম বড় ক্রাইসিস, এবং এটার সমাধান করা জরুরি- সেই দিকে খেয়াল দেয়ার সময় কই?

তারপরও হয়তো তরুণ আইনজীবীরা পড়াশুনা-গবেষণা করে ক্লায়েন্টকে সর্বোচ্চ সার্ভিস দেওয়ার চেষ্টা করে।

কখনো কখনো হয়তো ভাল শুনানি, সুন্দর উপস্থাপনা, যুক্তি-তর্ক প্রয়োগের মুন্সিয়ানার ফলে রিলিফ পেয়ে যাই।

অথচ, সমমানের মেরিটের অন্য একজন আইনজীবী হয়তো তার বাকপটুতা বা শুধুমাত্র শুনানির দক্ষতার অভাবে রিলিফ পান না।

তখন আবার অন্য ক্রাইসিসে পড়ে যাই।

প্রতিবার যখন শুধুমাত্র ভাল সাবমিশনের কারেণ রিলিফ পাই; তখন একটা হাদিসের কথা মনে পড়ে।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‌‌‘তোমরা আমার কাছে বিবাদ মীমাংসার জন্য এসে থাকো। আমিও একজন মানুষ।

হয়তো তোমাদের কেউ অপর কারো তুলনায় (নিজের পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশে) অত্যন্ত বাকপটু হয়ে থাকবে।

সুতরাং আমি তোমাদের কারো পক্ষে তার ভাইয়ের হকের কোন অংশের ফয়সালা দিয়ে ফেলতে পারি।

এ অবস্থায় আমি তার জন্য দোজখের একটি টুকরাই কেটে দিচ্ছি। অতএব (আসল বিষয়ে জ্ঞাত থাকলে) এর কোন কিছুই সে যেন গ্রহণ না করে’।

তরুণ আইনজীবীর স্পিরিচুয়াল ক্রাইসিস জহিরুল ইসলাম মুসা

(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি)
মানে বিচারক কোন বিষয়ে ফয়সালা দিলেও, সেটা হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম করতে পারে না।

এইসব বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে গুলায়ে যাই। ভয় লাগে।

নিজেকে বাকপটু মনে হয়, যে শুধুমাত্র কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে দোজখের টুকরা কিনে নিচ্ছি।
তরুণ আইনজীবীদের জন্য এসব বিষয় নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা-বিতর্ক-নসিহত না হইলে তো মুশকিল। মহা মুশকিল। কিন্তু এই মরার দেশে কে কারে উদ্ধার করবে জানা নাই।
জহিরুল ইসলাম মুসা
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *