চোখের পানি মুছে বাহিরে তাকিয়ে দেখি এখনো অন্ধকার হয়ে আছে ।
মসজিদের ইমাম সাহেব সবাই কে মাইকে বলছেন , ” প্রিয় এলাকাবাসী আজকে পবিত্র রমজানের শেষ দিন , সবাই তাড়াতাড়ি সেহরি খেতে উঠুন ৷ ”
কলোনির মধ্যে ২৩ টা পরিবার থাকতো, তাদের মধ্যে ১৭ টা পরিবার ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে ।
তাই কলোনির মধ্যে তেমন হইহট্টগোল শোনা যাচ্ছে না ।
আমি রুমের বাতি অন করে ব্যাগের ভেতর কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছি ।
এমন সময় দরজায় ঠকঠক করে কড়া নেড়ে উঠলো, নিশ্চয়ই বৃষ্টি এসেছে সেহরির খাবার নিয়ে ।
মা মারা যাবার পরে আমি বৃষ্টিদের বাসায় খাওয়া দাওয়া করি বিনিময়ে প্রতিমাসে চার হাজার টাকা তাদের দেই ।
– দরজা খুলে দিলাম বৃষ্টি আমাকে ব্যাগে কাপড় ভরতে দেখে বললো , কি করো এগুলো ?
(বৃষ্টি)
– কাপড় গোছাচ্ছি গ্রামের বাড়ি যাবো । (আমি)
– কার কাছে?
– বাবার কাছে!
– মানে কি ? তোমার বাবার খবর পাওয়া গেছে ? এত বছর পরে আবার কোই থেকে বের হলো ?
– সবকিছু পরে বলবো , আমাকে এখনই বের হতে হবে তুমি খাবার রেখে যাও আমি খেয়ে তারপর সাথে সাথে বেরিয়ে পরবো ।
– আমিও তোমার সাথে যাবো ।
– পাগল নাকি তুমি ? আমার নিজের সেখানে কেমন অবস্থা হবে জানিনা তারমধ্যে আবার তুমি ?
– তুমি খুব ভালো করে জানো যে আমি তোমার জন্য গ্রামের বাড়ি যাইনি ।
মা-বাবা যেতে চেয়েছে তবুও আমি যাবনা বলে তারাও যায়নি । আর সেই তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে ?
– দেখো বৃষ্টি, আমি যদি ফিরে আসি তাহলে সবকিছু আর কাউকে কিছু না বললেও তোমাকে বলবো ।
– কিন্তু তোমাকে একা কোথায় ছেড়ে দেবো আমার যে খুব ভয় লাগে ।
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ২য় পর্ব
– চিন্তা করো না তুমি , আমি ফিরে আসার চেষ্টা করবো ।
– মানে কি এসবের ? চেষ্টা করবো মানে কি ? বলো তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে ।
– বৃষ্টি তুমি কিন্তু ভালো করেই জানো যে, আমি একটুতেই অনেক রেগে যাই ।
তাই এই মুহূর্তে আমার রাগ বাড়িয়ে দিও না প্লিজ প্লিজ ।
– সারাক্ষণ কল দিয়ে কথা বলবে তো ?
– তা হয়তো পারবো না, কিন্তু আমি ঝামেলা শেষ করে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো । তুমি সেই বিশ্বাস রাখতে পারো ।
– ঠিক আছে তাহলে তুমি খাও আমি তাকিয়ে দেখি ।
– কোন দরকার নেই তুমি রুমে গিয়ে সেহরি খাও ৷
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ২য় পর্ব
বৃষ্টি আমাকে ভালবাসে, কলোনির মধ্যে আমরা একসাথে বড় হয়েছি ।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে ও গার্মেন্টসে চাকরি করা শুরু করে ।
আমি অবশ্য এসএসসি পাস করেছিলাম, তারপর মা মা’রা গেল আর আমারও পড়াশোনা সমাপ্ত হয়ে গেল ।
মা যখন মা-রা গেছে তখন আমার বয়স সতেরো বছর আর আজ ছয় বছর পরে আমার বয়স তেইশ ।
বাসা থেকে বেরিয়ে মিরপুর থেকে সরাসরি চলে গেলাম যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় ।
আমাদের কলোনির এক লোকের বাড়ির বাগেরহাট মোংলা তাই সে বলেছেন যে যাত্রাবাড়ী হয়ে গেলে নাকি সুবিধা হবে । অবশ্য আমার ইচ্ছে ছিল এখন থেকে কাছেই গাবতলী বাস স্টেশন থেকে যাবো ।
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় এসে দেখি হাজার হাজার মানুষের বাড়ি ফেরার প্রচেষ্টা । আমি ঠিক কি রকম গাড়ির মধ্যে উঠবো সেটা ভাবছি আর তখন চোখ পরলো একটা মহিলা তার স্বামীকে ঝাড়ি দিচ্ছে ।
মহিলার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা, মহিলার স্বামী বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে ।
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে আসলাম মাওয়া ঘাটে তারপর ফেরি পার হয়ে মাইক্রোবাসে করে সরাসরি বাগেরহাট ।
বাগেরহাট থেকে আবার লোকাল বাসে করে মোড়েলগঞ্জ বাস স্টেশন ।
সেখান থেকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, সূর্যমুখী গ্রাম এখান থেকে ৮ কিঃমিঃ দুরত্ব ।
মোটরসাইকেল করে ২০০ টাকার চুক্তিতে আমি উঠে বসলাম এবং প্রায় ২৫ মিনিট পরে আমি তালুকদার বড়ি মোশতাক সরোয়ার মিজান মানে আবার বাবার বাড়ি এসে পৌছলাম ।
মায়ের বলা বর্ননা সবকিছু ঠিক আছে, বাড়ির রং লাল ঠিকই কিন্তু সচ্ছ ঝকঝকে মনে কিছুদিন আগে রং করা
হয়েছে । আমি বাড়ির মধ্যে গেলাম, দুই সাইডে ফুলের গাছ তার মধ্যে দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা ঘরের সাথে
মিলেছে ৷ রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘরের সামনে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম ।
সিড়ির উপর একটা লোক বই হাতে বসে আছে, চোখে চশমা বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন ।
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ২য় পর্ব
– আমার দিকে তাকিয়ে দেখে আবারও বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন , কাকে চাই ?
(লোকটা)
– আমি মোশতাক সরোয়ার মিজান সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই ৷
– লোকটা বই থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
বাম হাত দিয়ে চোখের চশমা খুলে নিলেন কারণ চশমা শুধু বইয়ের জন্য ।
মানুষের সাথে কথা বলার জন্য না । বললেন , মোশতাক সরোয়ার কে তুমি চেনো না ?
– জ্বি না কখনো দেখিনি তবে আমার মা দেখলে চিনতে পারবে ।
– তোমার মায়ের নাম কি ?
– জ্বি ফারজানা কবিতা, আমি মোশতাক সরোয়ার সাহেবের ছেলে মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব ।
– ওহহ আচ্ছা ৷
– “এবার তিনি বসা থেকে উঠে সিঁড়ির সামনে গিয়ে দোতলার জানালায় তাকিয়ে ডাক দিলেন, মাহি কোই তুমি ? ”
– উপর থেকে চিকন কন্ঠে একটা মেয়ে বললো, জ্বি বাবা বলো ৷
( মনে হয় মেয়েটির নাম মাহি )
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ২য় পর্ব
– তোমার আম্মুকে নিয়ে নিচে আসো , তাকে বলো তোমার বড় আম্মুর ছেলে সজীব এসেছে ৷
আমি সিঁড়িতে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম , তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , তুমি থাকো তাহলে আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি ৷ বলেই তিনি পিছনের দিকে ফিরে রাস্তার দিকে হাটা শুরু করলো ।
একটু পরে ১৫/১৬ বছরের একটা মেয়ে ও মায়ের বয়সী এক মহিলা মাথায় কাপড় দিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো ।
আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেউ কিছু বলছে না , আমি একটু ইতস্তত বোধ করে নিজেই বললাম ; ”
আসসালামু আলাইকুম , কেমন আছেন আপনারা ? “
– এবার মহিলাটা মুখ ফুটে জবাব দিয়ে বললো, ওয়া আলাইকুম আসসালাম, আমরা সবাই ভালো আছি । তুমি কেমন আছো বাবা ? ”
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো ।
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ২য় পর্ব
– বাইরে দাড়িয়ে আছো কেন ? চলো ভিতরে চলো , ও মাহি তোর ভাইয়ের কাছ থেকে ব্যাগটা হাতে নে কত কষ্ট করে শহর থেকে এসেছে ।
আমি তাদের পিছনে পিছনে দোতলায় উঠলাম, উপরে গিয়ে একটা তালাবদ্ধ ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ।
“মহিলা বললো, ও মাহি ! তোর বাবার টেবিল থেকে এই রুমের চাবি নিয়ে আয় । ”
মাহি চলে গেল চাবি আনার জন্য দুই মিনিটের মধ্যে আবারও চাবি নিয়ে হাজির ।
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ২য় পর্ব
তালা খুলে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলাম, ভেবেছিলাম বদ্ধ ঘরে মনে হয় ধুলো ময়লা জমা থাকবে ।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল কারণ রুম ঝকঝকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । বিছানা ধবধবে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা,
চারিদিকে আসবাবপত্র সবকিছু অনেক নতুন নতুন লাগে ।
আমি খাটের ওপর বসলাম, মাথার উপর সিলিং ফ্যান চালু করা হলো ।
মহিলাটা আমার পাশে বসে বললেন, ” তুমি বিশ্রাম করে গোসল করো, আমি রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছি ।
মাহি তোমার কাছাকাছি আছে কিছু দরকার হলে ওকে বলবে । ”
– ” আমি বললাম, আসলে আন্টি আমি তো আগে কখনো আসিনি তাই কাউকে চিনিনা ।
এমনকি আপনাদের সাথেও তো পরিচয় নেই । ”
– ” শোন কথা ছেলের , আমি তোমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী আর তোমার ছোট মা আর এ হচ্ছে তোমার বোন মাহি ।
আর বাহিরে যার সাথে প্রথম দেখা হয়েছে সেই হচ্ছে তোমার বাবা । “
মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ২য় পর্ব
আমি অবাক হলাম, বাবাকে চোখের সামনে দেখে কিছু বলতে পারিনি । আমাকে দেখে বাবা রাগ করেছে নাকি খুশি হয়েছে মনে নেই । বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে আছে, অবশ্য এটাই হওয়ার ছিল ।
আমার মা নিজের ভুলের জন্য শাস্তি ভোগ করতে করতে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে ।
কিন্তু বাবা তো ভুল করেনি তাই পুনরায় বিয়ে করে সুখী হবার অধিকার বাবার আছে ।
ভাবছি রাতে বাবাকে জিজ্ঞেস করবো আমার মা’কে সে ক্ষমা করতে পেরেছে কিনা ?
তারপর গভীর রাতে এই বাসার ছাঁদে দাঁড়িয়ে মা’কে জানিয়ে দেবো । সৎ মা হলেও তার ব্যবহার আমার কাছে খুব ভালো লাগলো যা সচারাচর সবসময় দেখা যায় না ।
মাহি আমার বোন , সম্পুর্ণ নাম জানা হয়নি , সে আমার সাথে কথা বলতে একটু কেমন সঙ্কোচ বোধ করে । তার জড়তা কাটিয়ে দিতে হবে কিন্তু তার আগে নিজে ফ্রেশ হতে হবে ।