মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ১ম পর্ব

মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ১ম পর্ব

Rate this post

মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, ” সজীব এই চিঠিটা তোর কাছে রেখে দে বাবা , আমার মৃত্যুর কিছুদিন পরে পড়িস ।

এর মধ্যে তোর বাবার আর আমার জীবনের কিছু গোপন কথা লেখা আছে । বেঁচে থাকতে সেগুলো বলার সাহস পাইনি তোর কাছে, তাই চিঠিতে লিখে দিয়ে গেলাম ৷

আমি জানি তুই চিঠি পড়ার পরে আমাকে হয়তো অনেক ঘৃণা করবি ।

কিন্তু পৃথিবীতে এমন সত্য কথাগুলো তোর জানা দরকার তাই লিখে দিতে বাধ্য হলাম ৷

তবে চিঠিটা পড়া না পড়া সম্পুর্ণ তোর নিজের ইচ্ছে, জোর করবো না । ”

মা মারা গেছে ৬ বছর হয়ে গেছে কিন্তু আজও আমি সেই চিঠি পড়িনি ।

কারণ চিঠি পড়ে মা’কে ঘৃণা করতে হবে সেটা আমি চাই না । তাই কিছু কৌতুহল নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে চিঠিটা যত্ন করে সবসময় কাছে রাখতাম ৷

মাঝে মাঝে যখন পৃথিবীতে কেউ নেই জেনে আত্ম চিৎকার করি তখন পড়তে খুব ইচ্ছে করে ৷

কিন্তু অজানা এক বাঁধা পেয়ে আবারও ভাজ করে রেখে ঘুমিয়ে পরি ।

কিন্তু আজকে হঠাৎ মনের মধ্যে হতে বারবার কেবল চিঠিটা পড়ার জন্য ইচ্ছে জেগে উঠছে ।

তাই ৬ বছর ধরে জমিয়ে রাখা কৌতূহল দমন করে চিঠি খুলে পড়া শুরু করছি ।
বাবা সজীব ,
আমার মৃত্যুর পরে কেমন আছো তুমি? পৃথিবীতে থাকতে কষ্ট হচ্ছে খুব তাই না ?

আজকে এই চিঠিতে কিছু অপ্রিয় সত্যি ঘটনা তোমাকে জানাতে চাই ।

আশা করি তুমি সম্পুর্ণ চিঠি পড়বে, এরপর যদি আমাকে ঘৃণা করো তাহলে সমস্যা নেই কারণ আমি অপরাধী ।

আমার অপরাধের শাস্তি এই পৃথিবীতে আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন ।

বাকিটা হয়তো মৃত্যুর পরে আবার শুরু হবে কারণ পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না ।

তুমি ছোটবেলা থেকে জানতে তোমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে এবং এই পৃথিবীতে তোমার আর আমার আপন বলতে কেউ নেই । আসলে কথাটা সত্যি নয় ।

তোমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায় নি বরং আমি তোমাকে নিয়ে তোমার বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম ।

তোমার দাদার বংশে ও নানার বংশের অস্তিত্ব আছে ।

কিন্তু আমার করা ভুলের জন্য আজকে তোমার জীবনটা এলোমেলো ।

আমাদের বিয়ের আগে থেকে তোমার বাবা বিদেশে থাকতেন ।

৫ বছর বিদেশে থাকার পরে দেশে ফিরে আসলে তখন তোমার বাবার সাথে আমার বিয়ে হয় ।

আমি তখন একটা ছেলেকে ভালবাসতাম, কিন্তু আমার মা-বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারিনি বলে তোমার বাবাকে বিয়ে করেছিলাম ।

কিন্তু মন থেকে তোমার বাবাকে কখনো মেনে নিতে পারিনি তাই সবকিছু তাকে খুলে বললাম ।

তোমার বাবা আমাকে অনেক ভালবাসতো সেটা আমি আগেও স্বীকার করতাম এবং আজও স্বীকার করি ।

তাকে ছেড়ে চলে এসেছি তাই বলে যে তাকে মিথ্যে দোষ দেবো সেটা আমি ভাবতেও পারিনা ।

তুমি এতদিন ধরে জানো তোমার বাবার নাম ইকবাল কিন্তু সেটা ভুল, তোমার আসল জন্মদাতার নাম মোঃ মোশতাক সরোয়ার (মিজান) ।

মিজান আমাকে সবসময় ভালবাসা দিয়ে আমার অতীতকে ভুলানোর চেষ্টা করতো ।

কিন্তু আমি কখনো অতীতকে ভুলতে পারিনি বলে তোমার বাবাকেও ভালবাসতে পারিনি ৷

বিয়ের পরে ৫ মাস তোমার বাবা বাংলাদেশে ছিলেন আর তখনই তুমি আমার গর্ভে চলে এলে ৷

তোমার জন্মের আগমন বার্তা তোমার বাবা দেশে থাকতে শুনে গেছেন ।

তবে আমি তখন তোমাকে জন্মদিতে চাই নাই কারণ আমি অন্য কাউকে ভালবাসি ।

তাই আমি তোমার বাবা মিজানের সন্তানের জননী হতে চাইনি ।

কিন্তু তোমার বাবা ইচ্ছে করে তোমাকে পৃথিবীতে আনতে চেয়েছে কারণ তার ধারণা ছিল যে, একটা সন্তান হলে আমি স্বাভাবিক ভাবে সংসার করবো ।

মৃত্যুর সময় আমার মা আমাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন ১ম পর্ব

কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে পারি নাই ।

তোমার জন্ম হয়েছিল তোমার দাদা বাড়িতেই তখন তোমার দাদী জীবিত ছিল কিন্তু দাদা মৃত কবরবাসী ।

আমি কিন্তু তোমাকে নষ্ট করার জন্য অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু তুমিও শপথ করেছিলে হয়তো যে তুমি পৃথিবীতে আসবেই ৷

তাই বারবার বিভিন্ন ঔষধ খাবার পরেও তোমাকে নষ্ট করতে পারি নাই ৷

তোমার জন্মের পরে আমি তোমাকে দেখে অনেক খুশি হলাম ।

প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাকে তোমার দাদীর কাছে ফেলে রেখে আমি আমার পছন্দের মানুষের সাথে পালিয়ে বিয়ে করবো ।

কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা আর করতে পারি নাই ।

তোমার বয়স যখন এগারো মাস তখন তোমাকে নিয়ে আমি আমার নিজের ব্যাবহৃত গহনাপত্র এবং তোমার বাবার পাঠানো অনেকগুলো টাকা নিয়ে পছন্দের মানুষের হাত ধরে এই ঢাকা শহরে চলে আসলাম ।

মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ের মধ্যে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করে আমরা থাকতে শুরু করলাম ।

তোমার বাবাসহ পৃথিবীর সকল পরিচিত মানুষের সাথে আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম ।

এর ঠিক ৭ মাস পরে তখন তোমার বয়স ছিল আঠারো মাস ।

আমার পেটের মধ্যে প্রচুর ব্যাথা করতো আর হঠাৎ হঠাৎ করে ব্যাথায় অজ্ঞান হয়ে পরতাম ।

আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার পরে বললেন আমার পেটের মধ্যে ছোট্ট একটা ক্যান্সার সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু ভয়ের কিছু নেই ।

কারণ অপারেশন করলেই রোগী সুস্থ হয়ে যায় তবে কিছু টাকা খরচ করতে হবে ।

আমার কাছে টাকা অবশিষ্ট ছিল না কারণ সবকিছু আমি ওকে দিয়ে দিছিলাম কিন্তু গহনাপত্র ছিল ।

আমি তাকে বললাম, গহনাপত্র বিক্রি করে আমার অপারেশনের ব্যবস্থা করতে ।

সে গহনাপত্র বিক্রি করেছে ঠিকই কিন্তু সেটা আমার চিকিৎসার জন্য না ।

সে সেই মুহূর্তে আমাকে ওই হাসপাতালে ফেলে রেখে গহনা বিক্রির টাকা নিয়ে পালিয়ে গেল । তুমি তখন আমাদের বাসার পাশের ফাতেমা ভাবির কাছে থাকতে ।

ফাতেমা ভাবি পরবর্তীতে সবকিছু জেনে তার স্বামীর কাছে বলে ।

তার স্বামী বিষয়টা বাড়ির মালিকের কাছে বলে ।

বাড়ির মালিক সেই বছর হজ্জ করে এসেছেন, তিনি আমার চিকিৎসার জন্য ৪২ হাজার টাকা খরচ করেছেন ।

এবং তিনি আমাকে বলেছেন যে, আমি যতদিন তার বাসায় থাকবো ততদিনে কোন ভাড়া দিতে হবে না ।

একটা মানুষ এত ভালো হয় কিভাবে ? আমি জানিনা, তবে সেদিনই বিশ্বাস করেছি জগতে এখনো ভালো মানুষ আছে , তার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ ।

এরপর থেকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়ে গেল, আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম বারবার কিন্তু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা পারিনি ।

ফাতেমা ভাবির মাধ্যমে যোগাযোগ করে মিরপুরেই গার্মেন্টসে চাকরি শুরু করলাম ।

গার্মেন্টসের জব কতটা গালাগালি সহ্য করে করতে হয় সেটা শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকরাই জানে ।

সারাদিন অফিসের মধ্যে কাজ করতাম আর গালাগালি করলে কান্না করতাম ।

বাসায় ফিরে রান্না করে তোমাকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে সুয়ে থাকতাম ৷

তোমার বাবার সেই নিশ্বার্থ ভালবাসাকে স্মরণ করে বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতো ।

তোমার মনে পরে ? মাঝে মাঝে তুমি ঘুম থেকে উঠে দেখতে আমি কান্না করি ।

তুমি বলতে ” মা তুমি কান্না করো কেন ? সুমন কি তোমাকেও মেরেছে ?

” সুমন ছিল ফাতেমা ভাবির ছেলে , আমি অফিসে গেলে তোমাকে সবসময় মারতো আর তুমি কান্না করতে ।

তাই আমি কান্না করলেও তুমি মনে করতে যে সুমন মনে হয় আমাকে মেরেছে ।

আস্তে আস্তে কান্না করতে করতে চোখের নোনাপানি শুকিয়ে গেল ।

তুমি বড় হয়ে গেলে আমিও আর আগের মতো কান্না করতাম না ।

কলোনির সবার বাবা যখন আদর করতো তখন তুমি তোমার বাবার কথা জানতে চাইতে ।

কলোনির সবাই জানতো যে, ইকবাল তোমার বাবা কিন্তু কথাটা মিথ্যা ।

ওহহ তোমাকে বলা হয়নি, যার সাথে পালিয়ে এসেছিলাম তার নাম ইকবাল ।

তোমাকে এগারো মাসের শিশু অবস্থায় নিয়ে এসেছি তাই সবাই জানতো যে তুমি ইনবালের সন্তান ।

তাই কলোনির সবাই এবং আমি এতদিন তোমাকে ভুল জানিয়ে এসেছি ।

তুমিসহ কলোনির সবাই জানে যে তোমার বাবা একজন বিশ্বাসঘাতক বেঈমান ।

কিন্তু আজকে আমি তোমার কাছে প্রকাশ করছি, তোমার জন্মদাতা পিতা বেঈমান ছিল না ।

বেঈমান ছিল সেই মানুষটা যাকে আমি বিশ্বাস করে তোমার বাবাকে ঠকিয়েছি ।

তুমি বড় হয়ে যখন মাঝে মাঝে তোমার বাবাকে ঘৃণা করার কথা বলতে ।

তখন বারবার আমি বলতে চেয়েছিলাম যে তোমার বাবাকে ঘৃণা করো না কারণ সে ফেরেশতার মতো মানুষ ।

কিন্তু আমি তখন ভয়ে বলতে পারিনি তাই এ জীবনে বেঁচে থাকতে তোমাকে বলা হলো না ।

আমার মৃত্যুর পরে তুমি বড় একা হয়ে যাবে তাই আমি চাই তুমি তোমার বাবার কাছে ফিরে যাবে ।

আমার বিশ্বাস আজও তোমার বাবা তোমাকে ভালবাসবে ।

আমাকে এখন সে ভালবাসে কিনা জানিনা, তবে তুমি যদি সত্যি সত্যি যাও তাহলে তার কাছ থেকে চুপিচুপি জেনে নেবে ।

সে কি আজও আমাকে ভালবেসে নাকি ঘৃণা করে ?

জানার পরে গভীর রাতে আকাশে দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে দিও আমি শুনতে পাবো ।

জেলা;- বাগেরহাট ।
থানা;- মোড়েলগঞ্জ ৷
গ্রাম ;- সূর্যমুখী ।
গ্রামের মধ্যে গিয়ে তোমার বাবার নাম বললে সবাই দেখিয়ে দেবে ।

বলবে তালুকদার বাড়ি মোশতাক সরোয়ার মিজানের বাড়ি যাবো ।

বাজারের কাছে প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা ।

সেই রাস্তা দিয়ে সামান্য ভিতরে গেলে দেখবে রাস্তার বাম হাতে দোতলা পাকা বাড়ি ।

তোমার বাবা বিদেশে যাবার এক বছর পরেই টাকা পাঠিয়ে পাঠিয়ে ১০ মাসের মধ্যে ওই বাড়ি করেছিলেন ।

বাড়ির সামনের দিকে লাল রং করা আছে তবে এত বছর পরে রং হয়তো খসে গিয়েছে তাই নতুন কালার করতে পারে ।

তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমার সবকিছু খুলে বলবে ।

বলবে যে তাকে ছেড়ে আসার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তার কাছে ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি ।

আমি চাই যেদিন তুমি চিঠিটা পড়বে সেদিনই তুমি গ্রামের বাড়ি চলে যাবে ।

ঠিকানাটা মনে রেখো কিন্তু আবার ভুলে যেও না ।
ইতি,
তোমার আম্মু
ফারজানা কবিতা ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *