রসগোল্লা আসলে কার?
রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়’’
রসগোল্লা গল্পে সৈয়দ মুজতবা আলী রসগোল্লাকে এভাবেই সম্মানিত করেছিলেন ।
রসগোল্লা ছাড়া বাঙালির উৎসব-পার্বণ ঠিক জমে ওঠে না।
রসগোল্লার স্বাদটাই এমন যে এ নিয়ে সাহিত্যের শেষ নেই।
ধবধবে সাদা রসগোল্লা পছন্দ করে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
বাঙালিদের যেকোন অনুষ্ঠান মিষ্টি ছাড়া অপূর্ণ থেকে যায়। এর মধ্যে রসগোল্লার স্থান সবার উপরে।
আমাদের খাদ্যবিলাসের বিভিন্ন ধাপে রসগোল্লা যে কত রকমভাবে জড়িয়ে আছে, তার বর্ণনা দেওয়া বেশ কঠিন।
কিন্তু এই রসগোল্লা প্রথম কোথায় তৈরি হয়েছিল- এটি নিয়ে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল ভারতের দুই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা।
এভাবে স্বত্ব নিয়ে লড়াইয়ে পর রসগোল্লার জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
জেনে নেওয়া যাক রসগোল্লার জন্ম
বাঙালির ইতিহাস
কথিত আছে
রসগোল্লার কলম্বাস,
বাগ বাজারের নবীন দাস”
রসগোল্লা ও বাঙালির এ সম্পর্ক কিন্তু আজকের নয়।
তার হিসেব খুঁজতে গেলে যেতে হবে সেই ১৮৬৮ সালে।
গবেষকদের মত অনুযায়ী ১৮৬৮ সালে কলকাতায় বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাসের হাতে সৃষ্টি এই রসগোল্লা।
যতটুকু জানা যায়, একটি ছোট্ট মেয়ে নবীন দাসের কাছে বায়না ধরে,
”চটচটে নয়, শুকনো হতে মানা,
দেখতে হবে ধবধবে চাঁদপানা,
এমন মিষ্টি ভূ-ভারতে নাই,
নবীন ময়রা, এমন মিষ্টি চাই”
রসগোল্লা আসলে কার?
রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
অক্ষরে অক্ষরে নবীন দাস কথা রাখেন মেয়েটির, ছানা আর গরম চিনির রস মিলিয়ে ঠিক যেন চাঁদপানার মতোই তৈরী করলেন রসগোল্লা।
এই রসগোল্লাই মিলিয়ে দিলো নবীন দাস আর সেই মেয়েটিকে।
নাম যাঁর ক্ষীরোদমনি।
পরবর্তীতে বাগবাজারের তত্কালীন বিখ্যাত কবিয়াল “ভোলা ময়রা”র মেয়ে।
নবীন দাসের ঘরণী হয়ে আসেন এই ক্ষীরোদমনি।
দেশে-বিদেশে রাসগোল্লার বেশ কদর। আর বাঙালি পাতে পেল রসগোল্লা।
সেই থেকে বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে এক অটুট বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেল রসগোল্লা।
সেই রসগোল্লার কদর আজ গোটা পৃথিবীজুড়ে।
নবীন চন্দ্র দাসের হাতে তৈরি এই রসের গোল্লা যখন ধীরে ধীরে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল চারিদিক।
সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানে অতিথি অভ্যাগতদের পাতে পড়তে লাগল এই মিষ্টি।
দেশ-বিদেশেও এর চাহিদা বাড়তে থাকল।
রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
তবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ব্যবসায়ী ও রসগোল্লা ভক্তের অনেকে বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের কারিগরদের হাতেই রসগোল্লার জন্ম।
বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে ও অতিথি আপ্যায়ণে মিষ্টি পরিবেশনের বিষয়টি বহুকাল ধরেই বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর নানা প্রকারের মিষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হলো রসগোল্লা।
খাদ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক শওকত ওসমান বিবিসিকে বলেছেন, লিখিত কোনো প্রমাণ না থাকলেও, তাদের ধারণা, ষষ্ঠ শতকে দক্ষিণাঞ্চলীয় পটুয়াখালীতে পর্তুগিজরা দুধ থেকে পনির ও সন্দেশ তৈরি করতো।
সেগুলো দিয়েই বাঙালি স্ত্রীরা রসগোল্লা বা এ ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করেন।
তিনি আরও বলেন, রসগোল্লা আবিষ্কারক হিসেবে কলকাতায় যে নবীন চন্দ্রের কথা বলা হয়, তিনি বরিশাল অঞ্চলের লোক।
এক সময় তিনি পটুয়াখালীর কাছেই থাকতেন। তার হাত ধরে শিল্পটি সেখানে (কলকাতায়) যেতে পারে।
আর উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের মতে, রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চল।
বিশেষ করে, পর্তুগিজদের সময় পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার ময়রারা ছানা, চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে গোলাকার এক ধরণের মিষ্টান্ন তৈরি করেছিলেন।
সেটাই ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা নামে পরিচিত।
পরে বরিশাল এলাকার হিন্দু ময়রাদের বংশধর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা কিংবা উড়িশ্যায় বিস্তার লাভ করে।
কলকাতার আজকাল পত্রিকাও রসগোল্লার আবিষ্কার বিষয়ে একই তথ্য দেয়।
রসগোল্লার চাহিদার কথা মাথায় রেখে ১৯৩০ সালে নবীনের একমাত্র পুত্র কৃষ্ণ চন্দ্র দাস মহাশয়ের হাত ধরে শুরু হল রসগোল্লার প্রক্রিয়াকরণের প্রস্তুতি।
অভিনব পদ্ধতিতে টিনের কৌটোর মধ্যে ভরা হতে থাকল রসগোল্লা।
যাতে তাদের আয়ু বাড়ানো যায় ও খুব সহজেই সেই সব টিনের ক্যান রপ্তানি করা যায়।
এক কথায় ‘ক্যানড রসগোল্লা’।রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
আজ যে রসগোল্লার এত জনপ্রিয়তা, তার অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন এই কৃষ্ণ চন্দ্র দাস বা কে সি দাস।
পরবর্তী সময়ে কেসি দাসের নামের ব্র্যান্ডিং এবং তার বংশধরদের তৈরি করা মিষ্টি শুধু ভারতে নয়, গোটা পৃথিবীতেই সুনাম অর্জন করেছে।
তবে কলকাতার মিষ্টি আবিষ্কার নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে।
কেউ বলে রানাঘাটের বিখ্যাত মিষ্টান্ন হারাধন ময়রা একবারে দুর্ঘটনাক্রমে ফুটন্ত সিরাপে ছানার বল ফেলে রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন।
উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভবানিপুরের মল্লিক এবং শোভাবাজারের চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এই মিষ্টান্নটির চেহারা বদলে দেয়।
আবার বাংলাদেশের মানুষের মতে রসগোল্লা তাদের আবিষ্কার।
কারণ এই নবীন চন্দ্র দাস বরিশালে থাকতেন।
উড়িষ্যার ইতিহাস
রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
অন্যদিকে রসগোল্লাকে তাদের ৮০০ বছরের পুরনো নিজস্ব আবিষ্কার বলে দাবি করে ওড়িশ্যা।
তাদের প্রচলিত মত, রথযাত্রা শেষে সাত দিন খালার বাড়ি কাটিয়ে মন্দিরে ফেরার সময় রসগোল্লা ছিলো জগন্নাথ দেবের ‘পাসওয়ার্ড‘।
স্ত্রী লক্ষ্মীর মান ভাঙিয়ে মন্দিরে ঢুকতে হয় তাকে।
হাঁড়িভরা রসগোল্লা দিয়ে বৌয়ের মন গলান তিনি।
সেই রীতি মেনে এখনও মন্দিরের সেবায়েতদের একাংশ লক্ষ্মীর হয়ে ঝগড়া করেন।
কেন স্ত্রীকে ফেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন জগন্নাথ।
এ তর্কে রীতিমাফিক জগন্নাথের প্রতিনিধির হার হয়।
জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে না পেরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন বলে একটা সময়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না মুখ্য দয়িতাপতি।
‘পরেরবার আর এমন ভুল হবে না‘ বলে স্বামীর পক্ষ থেকে আশ্বাস পেয়ে লক্ষ্মীর মন গলে।
মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের কাছে লক্ষ্মী-নারায়ণের পুষ্পাঞ্জলি পূজার পরেই স্ত্রীকে রসগোল্লা-ভোগ অর্পণ করেন জগন্নাথ।
পুরী মন্দিরের এই ঐতিহ্যকে ধরেই ওড়িশ্যার দাবি, রসগোল্লা তাদের আবিষ্কার।
রসগোল্লা আসলে কার?
রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
রসগোল্লার সৃষ্টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আর উড়িষ্যা, দুই রাজ্যের মধ্যে একটা মিষ্টি লড়াই শুরু হয়।
এই লড়াইয়ের শেষ হয় সরকারী স্বীকৃতির মাধ্যমে।
পেটেন্ট নির্ধারণকারী সংস্থা জিআই জানিয়ে দিলো মিষ্টি-কুলশ্রেষ্ঠ রসগোল্লার জন্ম হয়েছিল বাংলার নবীন চন্দ্র দাসের হাতেই।
জয় হলো বাংলার। পেটেন্টের অধিকারী হলো বাংলা।
এই রসগোল্লা নিয়ে বিজয় উত্সব, গান, সিনেমা, বিদ্বজনদের বক্তব্য এসব অনেক কিছুই হয়েছে।
রসগোল্লা বাংলার মানুষের আবেগের সাথে মিশে রয়েছে।রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
এই মিষ্টি ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানই যেনো পূর্ণতা পায় না।
রসগোল্লার একাল
একবিংশ শতাব্দীর ব্যাস্ততায় মানুষ আজ অনেকটাই স্বাস্থ্য সচেতন।
আগেকার মতো বিয়ে বাড়ি বা অনুষ্ঠানে ১০-১৫টা রসগোল্লা কেউ সচরাচর খান না।
বড়জোর একটা কিংবা দুটো। কিন্তু তাতে ব্যবসা বা চাহিদায় কোনও ঘাটতি এসেছে?
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রসগোল্লায় এসেছে বিস্তর পরিবর্তন।
আজ আর শুধুমাত্র এই ধবধবে সাদা রসগোল্লা বাঙালির মেনুতে স্থান পাচ্ছে, এমনটা নয়।
শীতকাল চিনির শিরার বদলে গুড়ের শিরায় তৈরি হয় নলেন গুড়ের রসগোল্লা।
এছাড়া গরমকালের জন্য রয়েছে আম রসগোল্লা আর নতুন সংযোজন বেকড রসগোল্লা।
এই বেকড রসগোল্লার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। তেমনি বাড়ছে চাহিদাও।
রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
খাদ্যবিলাসী বাঙালির জীবনে ঝালের চেয়ে মিষ্টি প্রিয়। রসগোল্লা সেই জন্মলগ্ন থেকে বাঙালির আবেগের সাথে মিশে আছে। রসগোল্লা খেতে সবাই ভালোবাসেন এটা বলাই বাহুল্য। বাঙালি মাত্রই “মিষ্টি” শুনলে সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে রসগোল্লার চেহারা।
রসগোল্লা শুধু একটি মিষ্টি নয়, বাঙালির জীবনযাপনের সঙ্গে জুড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বারোয়ারি বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে রসগোল্লার বর্ণাঢ্য উপস্থিতি প্রমাণ করে, বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে এটি তৈরি করেছে ভিন্ন দ্যোতনা।
রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
রসগোল্লা আসলে কার? রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়
যে অঞ্চলগুলোতে দুধের প্রাচুর্য আছে, সে অঞ্চলগুলো রসগোল্লা এবং এ–জাতীয় মিষ্টি তৈরিতে বিখ্যাত হয়েছে। রসগোল্লা ও রসগোল্লাজাতীয় মিষ্টি তৈরিতে বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ স্থানগুলো হলো দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, বরিশাল, খুলনা, যশোর, ঢাকা, বিক্রমপুর, নরসিংদী ও কুমিল্লা।