সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে চলেছে।
দ্রুত বিশ্বায়ন, নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের কারণে যেকোনো কাজ এবং কাজের জন্য প্রয়োজনীয়
দক্ষতা সময়ের সাথে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
এজন্য বাংলাদেশ সরকারের নিকট একটি নতুন এবং আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
আজ সে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। তবে তার আগে আমাদের বর্তমান
শিক্ষাব্যবস্থার (Traditional Education System) দিকে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
মনে করুন, আপনি দশম শ্রেণীর একজন ছাত্র। আপনি সকাল ১০ টায় ক্লাসে ঢুকলেন এবং দেরি হওয়ায় শেষ
বেঞ্চে বসলেন। বেঞ্চগুলো সব সারি সারি করে টিচারের টেবিল বরাবর সাজানো। কিছুক্ষণ পর আপনার শিক্ষক
ক্লাসে আসলেন এবং রোল ধরে ধরে ক্লাসের উপস্থিতি নির্ণয় করলেন। ৮১ রোল ডাকতেই আপনি সাড়া দিলেন।
তেমন একটা ভালো ছাত্র না হওয়ায় আপনার রোল একদম শেষের দিকে। অর্থাৎ গতবছর আপনার ক্লাসে যিনি
পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো নম্বর পেয়েছিলেন তার সাপেক্ষে আপনার ক্রম ৮১ নম্বর।
যাই হোক, শিক্ষক পড়ানো শুরু করলেন। শিক্ষক কঠোর নির্দেশ দিলেন, তার ক্লাসে কেউ যেন পরস্পরের
সাথে কথা না বলে। আপনার দৃষ্টিতে সমস্যা থাকার কারণে আপনি বোর্ডের লেখাগুলোও বুঝছিলেন না।
আর এদিকে শিক্ষকের একঘেয়ে লেকচার আপনার খুবই বিরক্তিকর লাগতে শুরু করলো।
শিক্ষক একটা অধ্যায় পড়ানোর পর ক্লাস টেস্ট নিতে চাইলেন।
সবাইকে বই বন্ধ করে কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিলেন।
ক্লাসের বিরক্তিকর লেকচার মন দিয়ে না শোনার কারণে আপনি কিছুই লিখতে পারলেন না৷
এতে আপনার শিক্ষক আপনাকে তিরস্কার করলেন। এভাবে একটি ক্লাস শেষ হয়ে গেল।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বড় ধরণের পরিবর্তন আসতে
নতুন যে শিক্ষাব্যবস্থা আসতে চলেছে তা বুঝতে সহজ হবে যদি আপনি উপরোক্ত ঘটনাটি ঠিক বিপরীত
প্রেক্ষাপটে চিন্তা করেন। অর্থাৎ এ ক্লাসে বেঞ্চগুলো কখনোই শিক্ষকের টেবিল বরাবর (Teacher-centered)
হবে না; বরং গোল কিংবা চারকোনা টেবিলে (Learner-centered) শিক্ষার্থীরা বসবেন যাতে নিজেদের মধ্যে
আলোচনা করতে সুবিধা হয়। পরীক্ষার খাতায় গ্রেডিং পদ্ধতি থাকবে না যাতে করে রোলের মাধ্যমে একজন
শিক্ষার্থীর সাপেক্ষে বাকি শিক্ষার্থীদের ছোট করে না দেখা হয়।
শিক্ষা অর্জন কেবল জ্ঞান ভিত্তিক হবে না; হবে সক্ষমতা ভিত্তিক (Competency Based)।
সক্ষমতা কি? সক্ষমতা হল জ্ঞান, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গীর সমন্বয়।
অর্থাৎ এ শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল আপনার জ্ঞান এবং দক্ষতা নয়, বরং দৃষ্টিভঙ্গীকেও সমান ভাবে গুরুত্ব দেওয়া
হবে। যে বিষয়টা সম্পর্কে জানছেন কিংবা যে কাজটা শিখছেন, সেটি আসলেই আপনার মন থেকে আয়ত্ত্ব
করার ইচ্ছা কিনা তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।
এজন্য শিক্ষকরাও ক্রমাগত আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করার চেষ্টা করবেন।
পরীক্ষাটা হবে Open Book Method পদ্ধতিতে।
অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় তথ্য মুখস্ত করিয়ে আপনার মেধাকে সংকুচিত করা হবে না।
আর আপনার সক্ষমতাকে কোনো নম্বর দিয়ে বিচার করা হবে না।
আপনার পরীক্ষা হবে ৩ ধাপে-
1. Written
2. Demonstration
3. Oral
আপনি যদি আপনার সক্ষমতা পরিপূর্ণরূপে প্রমান করতে পারেন তাহলে আপনাকে “Competent” ঘোষণা
করা হবে। নতুবা আপনাকে “Not Yet Competent” ঘোষণা করা হবে।
এতক্ষণ অতি সংক্ষেপে যে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করলাম তাকে বলা হয় Competency Based
Education পদ্ধতি; সংক্ষেপে CBE System. ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে
সর্বপ্রথম এ পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত হয়।
বিংশ শতাব্দীতে এসে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসে ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ
আরও অনেক দেশ এ পদ্ধতিগ্রহণ করে। তবে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এ পদ্ধতি
প্রচলিত থাকলেও ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ কেবল কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের
আওতায় প্রচলিত আছে। কারিগরি শিক্ষায় এ পদ্ধতিকে বলা হয়, Competency Based Training and
Assessment (CBT&A). বাংলাদেশে ২০১০ সালে ILO এর তত্ত্বাবধানে TVET Reform Project এর মাধ্যমে
CBT&A পদ্ধতিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়।
সম্প্রতি কেবল কারিগরি শিক্ষা নয়, বরং সাধারণ শিক্ষা স্তরের জন্যও (প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চতর শিক্ষা) CBE পদ্ধতিতে বাংলাদেশে যে নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে সেই শিক্ষা কাঠামোকে BNQF বা Bangladesh National Qualification Framework বলা হয়। সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এ প্রস্তাবের অনুমোদন দেন। তবে এখনও চুড়ান্তভাবে বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন বাকি। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে পিএইচডি পর্যন্ত সকল ধাপকে ১০ টা লেভেলে ভাগ করা হবে।
আরো তথ্য জানার জন্য ভিজিট করতে পারেন: