১.
“এই ছেলে, সোফায় বসো না! এখানে বসো।”
বলে ফ্লোরের দিকে ইশারা করলেন অধ্যাপক এম.এস.রায়হান।
আশরাফ নিষ্পাপ চোখে তাকালো।বয়স সবে বারো।
মামার সাথে শখ করে এসেছিল বড় স্যারের বাড়ি দেখবে বলে।
ভদ্রলোকের বলা বাক্যটি যেন তার ছোট্ট কিশোর হৃদয়ে আঘাত হানল।
আশরাফের মনে আছে বড়স্যার যখন তাদের বাড়িতে যেতেন, মামা আর নানাভাইয়ের সে কী আনন্দ!
এটা ওটা যা পারতেন আয়োজন করতেন। বাজারও করতেন দুহাত ভরে।
আশরাফ ভাবনা থামিয়ে তীব্র অপমান হজম করে বসে যায় মেঝেতে।
চোখের কোণে হালকা জলের আভাস পেলো কী?
খাবার টেবিলে বসে আরেক দফা অপমানের শিকার হলো আশরাফ।
খাবারের মেন্যুতে মুরগীর হাড়গোড় দিয়ে ডাল আর আলুভাজি ছাড়া কিছুই নেই।ভাতের অবস্থাও শোচনীয়।
কেমন গন্ধ গন্ধও লাগছে।আশরাফ আড়চোখে মামাকে দেখল।মামা গোগ্রাসে খাচ্ছেন।
মাঝেমধ্যে দু’একটা প্রশংসার বাক্যও ছুড়ছেন।
অথচ এই মামাকেও সে সময়মতো গরম ভাত না পেলে মামীর গায়ে হাত তুলতে দেখেছে।
মামার চাটুকারিতা মূহুর্তেই তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ধরে ফেলে,সাথে জন্মায় খানিকটা বিতৃষ্ণা
১. “এই ছেলে সোফায় বসো না! এখানে বসো।”লেখনীতে
২.
সময় গড়ায় । আশরাফ আরো একটু বড় হয়।জীবনের খাতা থেকে কিছু বছর হারায়।
নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হয়।আজ দ্বাদশ শ্রেণির শেষ পরীক্ষাটি শেষ হবার পরই খবর আসে নানুর অবস্থা ভালো নয়।
আশরাফ রিকশায় চাপে।স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে রিকশা।
চারিদিকে মানুষের চিৎকার ভেসে আসে।
জনবসতিতে পূর্ণ এই ঢাকা ছেড়ে প্রকৃতিতে হারাবার সাধ জাগে।
হঠাৎ এক ভদ্রলোকের চিৎকারে ধ্যান ভাঙে আশরাফের।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখে একজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে বিশ্রী ভাষায় ঝগড়ায় মেতেছেন কোর্ট টাই পড়া এক ভদ্রলোক।
আশরাফের মনে পড়ে ছোটবেলার সেই তিক্ত স্মৃতি।মাথায় সূঁচালো যন্ত্রনা হয়।
প্রতিবাদী মন আগের বার ছাড় দিলেও এবার আর চুপ রইল না।
হাতের ইশারায় রিকশা থামিয়ে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলো সে।
কাছে আসতেই বিশ্রী শব্দগুলো কানে স্পষ্ট বাজতে লাগলো।
আশরাফের মন তিক্ততায় ভরে ওঠে।যথাসম্ভব ভদ্রকন্ঠেই বলল,
১. “এই ছেলে সোফায় বসো না! এখানে বসো।”লেখনীতে
–“আংকেল এভাবে কথা বলছেন কেন উনার সাথে?
কী সমস্যা সেটা ভালোভাবে বললেই হতো।”
ভদ্রলোকের মেজাজ যেন এবার আকাশ ছুঁলো।
ক্যাটক্যাটে গলায় বললেন,
— ” ছোটলোকের বাচ্চা, ত্রিশ টাকার ভাড়া পঞ্চাশ টাকা চায়। কত্ত বড় সাহস!”
১. “এই ছেলে সোফায় বসো না! এখানে বসো।”লেখনীতে
আশরাফ রিকশাওয়ালা লোকটির দিকে তাকায়।
গরমে কপালের পাশ বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। মুখটা একরকম চুপসানো।
এতক্ষণ দুএকটা প্রতিত্তোর করলেও এখন আর আগ্রহ পাচ্ছে না।
এয়ার কন্ডিশনের ঠান্ডা হাওয়ায় বসে টাকা কামানো লোকটা কী করে বুঝবে একজন রিকশাওয়ালার জীবনের মুদ্রার ওপিঠের গল্পটি!
লোকটি খানিকটা মিনমিনে গলায়ই বলল,
১. “এই ছেলে সোফায় বসো না! এখানে বসো।”লেখনীতে
— “আচ্ছা স্যার, আপনার যা মন চায় দ্যান, তবুও এডি বন্দ করেন,লোকজন জইম্যা….আল্লাহ!
একটা দমকা হাওয়ায় কিছু দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়লো।
পিছঢালা রাস্তায় মিশে থাকে রক্তমাখা দেহ।
যে রিকশাওয়ালাকে এতক্ষণ ছোটলোকের বাচ্চা বলে ভর্ৎসনা করছিলো সেই ছোটলোকের কাঁধে চড়েই তার পাড়ি দিতে হলো পরকালের ভ্রমনে।
ধূলোময়লার সেই পুরুষের বস্ত্রের ধূলোর মতোই মিশলো সে অহংকার!
১. “এই ছেলে সোফায় বসো না! এখানে বসো।”লেখনীতে
৩.
আশরাফের আজ বেজায় তাড়াহুড়ো! মায়ের প্রেশার বেড়েছে। ডাক্তারের কাছে নেয়া প্রয়োজন।
এর মাঝেই এলো এক অপ্রত্যাশিত খবর!
অধ্যাপক এম.এস.রায়হান নিজ বাড়িতে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেছেন।
তাকে জোরাজুরি করা হচ্ছে যাওয়ার জন্য।
১. “এই ছেলে সোফায় বসো না! এখানে বসো।”লেখনীতে
আশরাফ আশ্বাস দিয়ে ফোন নামালো।বৃষ্টির পানিতে পোশাক নষ্ট করে কেউ জানাজায় যেতে চাচ্ছে না।
যে মানুষের জুতো খুলে দেবার জন্যও লোক প্রয়োজন হয়, তার মূল্য নাকি পোশাকের চেয়ে কম।
টাকার পাহাড় গড়ে লাভটা কী?
আফিফা টুপি এনে দেয়। আশরাফ স্নিগ্ধ চোখে তাকায়।
–“আমি যদি ফিরে না আসি তবে মাফ করে দেবেন.।”
আফিফা হালকা হেসে বলে, “সৃষ্টিকর্তা আপনাকে আমার আগে না নিয়ে যাক।”
আশরাফ শুনতে পায় না । দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় গন্তব্যে।
১. “এই ছেলে সোফায় বসো না! এখানে বসো।”লেখনীতে
পরিশিষ্ট: কবর স্থানের এক হাঁটু সমান পানিতে কোনরকম কবর খোঁড়া হলো।পা- জামাটা আরো খানিকটা উঠিয়ে খাটিয়া কাঁধে তুললো আশরাফ।সৃষ্টিকর্তার কি অদ্ভুত খেলা !
যে ভদ্রলোকের মূল্যবান সোফায় তার জায়গা হয়নি আজ তার মূল্যহীন দেহটাই তার কাঁধে।
সেই কাঁধেই ভর দিয়েই শুরু তার অনন্তকালের পথযাত্রা…
কীসের এতো অহংকার?
মৃত্যুই যেখানে উপসংহার!